বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে যত ট্রাজেডি রয়েছে, প্রত্যেকবারই এই ঘটনাগুলোর পেছনে প্রকৃত কারণগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ নোটেবল সমস্যাগুলো লাইমলাইটে না এসে আবেগঘন মুহূর্তের বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। এসব ট্রাজেডি গুলোর পেছনে প্রত্যেকবার অনিয়ম, দুর্নীতি ও সামাজিক ব্যর্থতা লুকিয়ে থাকলেও আমরা বরাবরই তাদেরকে উপেক্ষা করে যাই। যেমন ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্রাজেডির মূল কারণ ছিল অপরিকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল নির্মাণ, দুর্নীতি, ও শ্রমিকদের ক্ষমতা-হীনতা। ভবনের অনুমোদন, তদারকি, সার্টিফিকেট—এসব প্রক্রিয়ায় আগে থেকেই প্রচুর ঘুষ ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। অথচ রানা প্লাজা ঘটনার পরবর্তী সময় থেকেও ঢাকা শহরে যত ভবন গড়ে উঠেছে, ভালোমতো খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই ভবনগুলোও টাকার স্বরচিত অনুমোদন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের অংশ হয়ে উঠেছে। এত বড় ট্রাজেডি ঘটার পরেও আমরা নিজেদেরকে সংশোধনের পথ বেছে নেই নি।
আমরা যদি সাম্প্রতিক মাইলস্টোন ট্রাজেডির দিকে তাকাই, মাইলস্টোনে যখন বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, তখন স্কুলের রেগুলার ক্লাস নয়- বরং রেগুলার ক্লাস শেষে একট্রা কোচিং ক্লাস চলমান ছিল।
মাইলস্টনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই আমরা দেখতে পাই কিভাবে এক গোষ্ঠী ওই এলাকা এবং মিডিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলে। সঠিক তথ্য ও জিজ্ঞাসাবাদের দরজা শুরুতেই বন্ধ করে ফেলে- যা আমি পরবর্তীতে আমার মাইলস্টোন কলেজে অধ্যয়নরত বন্ধুর কাছ থেকে আরো নিশ্চিত হই। সাম্প্রতিক ঐ ট্রাজেডিজে নিহত শিক্ষার্থী আফিয়া এর মা (তার আরেক সন্তানও মাইলস্টোন এর শিক্ষার্থী ) কাছ থেকে স্পষ্ট বক্তব্য ফুটে ওঠে-
“আমাদের কে একটু বলেন (দুর্ঘটনার পরে অবস্থা জানার জন্য) যে কি হইতেসে। ওরা আমাদেরকে কিচ্ছু বলে নাই। কিচ্ছু বলে নাই। আমার সামনে প্লেনে করে সব নিয়ে গেসে। সব উঠায়া নিয়ে গেসে। আমার ছেলেটার উপর ওর টিচার গায়ে হাত তুলতেসে- (কারণ) কেন ও আন্দোলন করতেসে বাচ্চাদের নিয়ে। আপনারা বলেন আমরা কি উচ্ছৃঙ্খল কিছু করেছি? এগ্রেসিভ কিছু করেছি? তাহলে টিচার রা কেন এমন করলো? ইভেন আমি আগেও যখন লাইভ করেছি, তখন আমাকে হুমকি দিয়েছে যে -আপনি এত কথা কেনো বলেন? আপনার বাচ্চাকে কিন্তু তুলে নিয়ে যাবো। একটা মারা গেসে না? আরেকটাকে উঠায়া নিয়া যাবো”
এরপর তিনি আরো বলেন, “ এইটা (মাইলস্টোন) একটা রক্তচোষা প্রতিষ্ঠান। এইখানে যেই বাচ্চারা কোচিং করে, তাদেরকে (টিচাররা) আদর করে। আমার মেয়েকে আমি কখনো কোচিং এ দেই নাই। আমি বাসায় পড়াই। আমার মেয়ে বারবার যেয়ে বলে আম্মু, আমারে কোচিং এ দাও। যারা কোচিং করে, তাদেরকে (টিচাররা) আদর করে। যারা কোচিং না করে, তাদেরকে আদর করে না। আমি বাধ্য হয়ে আমার ময়না পাখিটারে (স্কুলের) কোচিং এ দিসি ভাই। আমি আমার ময়না পাখিটারে দিসি, ওরা আমার সোনা পাখিটারে পুইড়া দিসে। ওরা কোচিং না করলে জোর করে বাচ্চাদেরকে ফেইল করায়।”
আজ শুধু মাইলস্টোন স্কুল নয়, বরং ঢাকা শহরের যেকোনো সনামধন্য প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিলেই এমন স্কুল পরবর্তী স্কুলের মধ্যেই কোচিং বাণিজ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। আহ্লাদের সুরে এর নাম দেয়া হয়েছে “শিক্ষার ছায়া প্রতিষ্ঠান”। এই ছায়ায় না আসলে না আপনার সন্তান পাবে শিক্ষকদের আদর, না পরীক্ষার খাতার মার্কস।
স্কুলের কোচিং সম্পর্কে যদি আপনি প্রশ্ন তুলেন, তাহলে টিচার স্বরূপে ব্যবসায়ীরা এসে আপনাকে বলবে, “আরে ভাই আপনি জানেন এদের সিলেবাস কত বড়? এক ক্লাসে কত বেশি শিক্ষার্থী থাকে? ক্লাসে তো এদেরকে পড়ানো যায় না। তাই এদেরকে এক্সট্রা কেয়ার হিসেবে এই কোচিং করিয়ে থাকি আমরা।”
প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকারা, আপনাদের যদি শিক্ষার্থীদের “কেয়ার” করার এতোই সদিচ্ছা থাকতো, তাহলে আপনারা প্রতি ক্লাসরুমে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী নিতেন না। কিন্তু আপনারা প্রতি ক্লাসরুমে কতজন করে শিক্ষার্থী নেন? নেন ৪৫ থেকে ৬০ জনের মতো। কেন? আমাদেরকে কি আপনারা গরুর বা মুরগির খামার ভাবেন? একটা ক্লাসে যদি ৬০ জন করে শিক্ষার্থী থাকে, আপনি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণই বা করবেন কখন আর পড়াবেনই কখন? ইউনিভার্সিটি লেভেলে হলেও এক হিসাব- কারণ তখন সবার মধ্যে ম্যাচুরিটি আসে আর ক্লাসে দুষ্টুমি করার স্বভাব ক্রমাশয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু আপনি কখনোই এতো বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলের ক্লাসরুমে পড়াতে পারবেন না। বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবেই দুষ্টুমি করবে- ওরা না করলে কে করবে? তাই পড়াশোনা ও সার্বিক নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করে একটি শ্রেণিকক্ষে ২০ জন শিক্ষার্থীর বেশি নেয়ার অবকাশ নেই। কিন্তু দেখা যায়, আপনারা স্কুলে ভর্তির সময় যত বেশি শিক্ষার্থী নেয়া যায়, এমন একটা মনোভাবে থাকেন। প্রয়োজনে ক্লাসরুমে ২/৩ টা বেঞ্চ বাড়িয়ে দেয়ার নিয়তে থাকেন যেন একটা ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীও হাত থেকে ফসকে না যায় ! যত বেশি শিক্ষার্থী, তত বেশি লাভ। আর এতোই যদি “কেয়ার” করার ইচ্ছা আপনাদের মাঝে লুকায়িত থাকে, তাহলে কোচিং ক্লাস এর জন্য আলাদা করে ফী নিচ্ছেন কেন?
টিচারদের কাছে এধরণের বক্তব্যের জন্য একটা অকাট্য কাউন্টার সবসময় প্রস্তুত থাকে- বাবা বাংলাদেশে তো প্রচুর শিক্ষার্থী। এতো জায়গা পাবো কোথায়?
দেখুন, আপনারা নিরক্ষরতার হার কমাতে এতোই ব্যস্ত যে প্রকৃত শিক্ষার মানদণ্ডই কমিয়ে ফেলছেন ! তা কিভাবে এক্সেপ্টেবল ? দশটা এ বি সি ডি জানা লোকের চাইতে একজন প্রকৃত শিক্ষায় দীক্ষিত লোক জাতিকে সামনে নিয়ে যাবে বহুদূর। আপনারা শিক্ষা-বাণিজ্যকে পূঁজি করে সেই সুযোগটুকুও নষ্ট করে দিচ্ছেন।
প্রাইভেট ব্যাচ এ যখন শিক্ষকরা পড়ান তখন তার সামনে থাকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাথার উপর ১০০০ টাকা এর একটি ট্যাগ দেখতে পান। এই শিক্ষার্থী থেকে এই মাসে এক হাজার টাকা আসছে, ঐ শিক্ষার্থী থেকে এই মাসে এক হাজার টাকা আসছে- কিন্তু ওই একই শিক্ষক যখন স্কুলের ক্লাসরুমে পড়াতে যান তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর সরাসরি ওই টাকার ট্যাগ দেখতে পান না। তখন ঐ শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানো তার জন্য দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতীকী ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানগুলো ভেতরে শোষণতন্ত্রের সূচনা করেছে। আপনি কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বলতে গেলে শুনতে হবে, ‘সন্তানকে নিয়ে অন্য কোথাও যান তাহলে!’ এই ধমকের আওতায় যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে জরিমানা থেকে শুরু করে কোচিং ক্লাস সাজিয়ে লাখ লাখ টাকার অর্থ উৎসব গড়ে উঠেছে।
আমাদের শিক্ষকরা একাধারে সবই হয়ে উঠলেন- অমানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীও। শুধুমাত্র মহৎ হয়ে উঠতে পারলেন না !
কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে এবং পড়াশোনার সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতকরণে কণ্ঠ সর্বদা শক্ত থাকবে। অবিলম্বে সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে এর জন্য সুযোগ গড়ে তোলার সম্মিলিত প্রচেষ্টা করে যেতে হবে।
একটি ফুলে কখনো বসন্ত হয় না। কিন্তু প্রতিটি বসন্তই একটি ফুল দিয়ে শুরু হয়। আজকের এই লেখা শিক্ষার পুনঃজীবন, পুনরুত্থান এবং বিপ্লবের একটি ফুল হয়ে থাকুক।
আগে বুঝতাম না, আপু ভাইয়া-রা কেনো দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়. এখন যতো বড়ো হচ্ছি, ততোই বুঝতে পারছি যে, আমার দেশ তার নিজের মানুষেরই potential কে ধ্বংস করে ফেলে আর এমন এক loop এ ফালায় যেটাকে কেউ break করতে পারে না. এর থেকে ভালো loop ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া.
দিন শেষে বাঙালি জাতি ওই টাকার পিছনেই গাধার মত ঘুরবে আর বই মুখস্ত করবে। কারণ ডাক্তার হতে হবে কারণ , বড় বড় ডাক্তাররা দিন এ ১-২ লাখ টাকা কামায়। ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে কারণ ইঞ্জিনিয়ার দের অনেক টাকা। বাঙালি আর যেকোনো কিছু কাজের পিছনে মোটিভেশন খুজতে থাকলে এক পর্যায়ে গিয়ে ঐটা টাকা থেকেই শুরু হয়। আত্মতৃপ্তি বিষয়টা সবাই বই এ ঠিক ই পড়ছে কিন্তু তার দৌড় ওইটুকু ই