আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, নানাবিধ মুহূর্তের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ফলে ওইসময় টা আমার জন্য জাহান্নাম হয়ে উঠেছিল। আমি স্কুলে যেয়ে পুরো সময়টা চুপচাপ কাটিয়ে দিতাম। টিফিন পিরিয়ডে, বা সুযোগ পেলেই ফ্লোরের করিডোরে এসে দাঁড়াতাম। দাঁড়িয়ে গ্রিলে হাতের উপর হাত রেখে বালিশ বানিয়ে মাথা রেখে আকাশটা দেখতাম। চারিদিকে সবার উৎসব-কোলাহল। শুধু আমি স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়ে আকাশের মাঝে কবিতা খুজতে এসেছি।
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে আমি আকাশে ঠিক কি দেখতাম, আমি এর কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারবো না। কারণ এখানে সঠিক-ভুলের প্রশ্নই নেই। আমি শুধুই আকাশ দেখতাম। আকাশ দেখতাম ব্যাপারটাকে আরো খোলাসা করে বলতে চাইলে বলবো, আকাশে মেঘ দেখতাম। আমার কাছে মনে হয় মেঘরা স্বপ্ন বয়ে বেড়ায় । পুরো শহরজুড়ে স্বপ্ন জোগাড় করতে থাকে, একইসাথে স্বপ্নগুলকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন হচ্ছে অন্যের মধ্যে নিজের স্বপ্নগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়া। মনে হতো, এই গুরুভার মেঘ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আকাশজুড়ে স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে, দেখে তখন নির্বাসিত অবস্থাতেও মনে আশার সঞ্চার হতো। নিশ্চয়ই সামনের দিনগুলো অনেক ভালো হবে, এ ধারণা পেতাম। সত্যি বলতে, তখনকার দিনগুলো থেকে আজকের দিনগুলো বেশ ভালো, তা নিঃসন্দেহে বলতে পারবো। মাঝে মধ্যে দুই এক সহপাঠী হাস্যরস হিসেবে গণণা করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতো, "কি দেখতেসোস? কি হইসে তোর, বল আমারে" প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ফেরত যেতো তাদের উৎসবে। করিডোরের গ্রিল লোহার হওয়াতে সূর্যের আলোতে অনেকসময় এতো গরম হয়ে যেতো, তবুও সেই তাপ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমি অনুভবই করতাম না, আকাশ দেখার প্রতি আমার এতোই ঝোঁক ছিল। হাতের তৈরি বালিশের উপর লোহার গ্রিলের তাপ লেগে রান্না হচ্ছে তা একবার অন্য এক সহপাঠী ধরিয়ে দেয়ার পরে আমার টনক নড়েছিল।
একসময় খেয়াল করলাম, আমার চারপাশের সবার মাঝে আকাশ এবং মেঘের ব্যাপারটা অনেক বিখ্যাত হয়ে উঠছে। হঠাৎ যেনো কি হলো, সবাই আকাশ, মেঘ পছন্দ করতে শুরু করলো। গুনগুন করে আকাশ নিয়ে গান গায়, মেঘ নিয়ে কবিতা খোঁজে। ভালোবাসা উৎসর্গ করে। সবার মধ্যে আকাশের ছবি তুলে স্টোরিতে দেয়ার ধুম লেগে গেলো।আমার একটা অভ্যাস হলো আমি কোথাও বেশি মানুষ দেখলে সেখান থেকে সরে যাই। আকাশ নিয়ে উৎসব শুরু হওয়াতে তখন সেই ভীড় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি। এরপর থেকে আগের মতো মন দিয়ে খুব একটা আকাশ দেখিনি।
আমার কাছে মনে হয়, আমি আজকে যেই আরাফ, তার পিছনে ওই আকাশ দেখার সময়টুকুর এক বিশাল প্রভাব আছে। আমি সেই নির্বাসিত দিনগুলোর মাঝেও অবিশ্বাস্য সুন্দর স্বপ্ন দেখতাম। তবে এখন আর আগের মতো স্বপ্ন দেখিনা বহু দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। দেখিনা বলতে দেখতে চাই না, তেমন না। বরং স্বপ্ন দেখার জন্য আমি আকুল। তবে দেখতে পারছি না কোনো এক কারণে। আমার কাছে এখন মনে হয়, এই কারণটা হচ্ছে আকাশ দেখা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আসা। এখন আমি আমার পুরোনো যত স্বপ্ন ছিল, সেগুলোকে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছি। এখন বুঝতে পারছি, ঐ সময়টাতে আমার মধ্যে আকাশের মেঘগুলো শহরের স্বপ্নগুলোকে এনে জমা করছিল। নিজেকে আকাশ দেখা থেকে সরিয়ে এনে সেই স্বপ্নগুলো থেকে নিজেকে ছিন্ন করে ফেলেছি, নিজেকে বঞ্চিত করেছি। বিষয়টা উপলব্ধি করার পর থেকে খুবই আত্নগ্লানিতে ভুগছি। গাছের সালোকসংশ্লেষণের জন্য যেমন সূর্যের আলোর প্রয়োজন, আমার স্বপ্নের সালোকসংশ্লেষণের জন্য তেমনি আকাশ দেখা প্রয়োজন। আবারো আকাশ দেখা শুরু করবো। অনেকদিন ধরে কোনো স্বপ্ন দেখতে পারছি না। স্বপ্ন, আশা- ভেতরের সবই ফুরিয়ে এসেছে। আকাশ নিশ্চয়ই আমাকে খালি হাতে ফেরাবে না !
আকাশ এবং মেঘদলের কাছে যেয়ে আগে ক্ষমা চাইতে হবে। ভেবেছি মৌসুমি ভৌমিক এর 'আমি শুনেছি সেদিন তুমি' গানের শেষের অংশটুকু গেয়ে ক্ষমা আবদার করবো-
আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনও স্বপ্ন দেখো
এখনও গল্প লেখো, গান গাও প্রাণ ভরে
মানুষের বাঁচা মরা এখনও ভাবিয়ে তোলে
তোমাদের ভালোবাসা এখনও গোলাপে ফোটে
আস্থা হারানো এই মন নিয়ে আমি আজ
তোমাদের কাছে এসে দু'হাত পেতেছি
আমি দু'চোখের গহ্বরে শূন্যতা দেখি শুধু
রাত ঘুমে আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না
তাই স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু'চোখ পেতেছি
তাই তোমাদের কাছে এসে আমি দু'হাত পেতেছ
Insta story dekhar por ei app eo chole ashchi 😋